গণমানুষের অংশগ্রহণে গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারি ফ্যাসিস্ট সরকার যখন পতিত হয় তখন তাকে গণঅভ্যুত্থান বলা হয়। ৫আগষ্ট লাখো ছাত্রজনতার ঢাকা আগমনের মধ্য দিয়ে ১৬ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শেখ হাসিনা পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান। গণরোষ থেকে হাসিনা প্রাণে বাঁচলেও ফ্যাসিজমের সকল স্থান, চিহ্ন গুড়িয়ে দেয় সাধারণ মানুষ।
এই সাধারণই গণমানুষ। বাংলাদেশের সংবিধানে যাদেরকে ‘জনগণই সার্বভৌম’ বলা হয়েছে। ‘জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিতে’ রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের মালিকানা বলতে রাষ্ট্রের উপর সাধারণ মানুষের মালিকানার কথা বলা হয়। যাদের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। গত ১০ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারি সরকার জনগণের বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর নামে ‘বাংলাদেশ কোম্পানিতে’ পরিণত করেছিল এবং যার কর্তা হয়ে বসেছিল শেখ হাসিনা।
কোটা বিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন ৩ আগস্ট থেকে মূলত ফ্যাসিবাদ পতনের ১ দফায় পরিণত হয়েছিল। শহীদ মিনারে লাখো জনতার সমাবেশের মাধ্যমে আন্দোলন ছাত্রদের আন্দোলন থেকে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার মিলিত গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতার চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। ‘বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’ থেকে আবারো প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত মালিক জনগণের কাছে ফিরে আসে তাদের প্রিয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতার আত্ম বলিদানের মধ্যে দিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ ধরে যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। লুট হয়ে যাওয়া দেশ আবারো ২০২৪ এর ছাত্রজনতার আত্মাহুতির মাধ্যমে নিজেদের মালিকানায় ফেরত পায়।
৩ থেকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতে লাখো মানুষের এই-স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদের অভিভূত ও বিস্ময়াভিভূত করেছিল। আমরা যেন অবাক তাকিয়ে দেখেছিলাম এই অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। এইসব গণমানুষেরা কেন শেখ হাসিনার পতন চেয়েছিল? এদের তো কোটা থাকা না থাকা নিয়ে খুব বেশি প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি ছিলনা। কোটি মানুষের বাংলাদেশে প্রতিবছর সরকারি চাকুরিইবা কতগুলো। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেগুলো পাওয়ার সুযোগইবা সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিক মুটে মজুরের সন্তানদের কতটুকু? তবে কেন তারা শেখ হাসিনা উৎখাতের গণঅভ্যুত্থানে গণমানুষ হয়ে হাজির হয়েছিল?
তারা মুক্তি চেয়েছিল। কিসের মুক্তি? বৈষম্যের মুক্তি। কোন বৈষম্যের? প্রতিদিনের জীবন যাপনে বৈষম্যের? দীর্ঘদিন ধরে তারা দেখেছে সাধারণ মানুষ হিসেবে এই রাষ্ট্রের কোথাও তাদের কোন অধিকার নেই। ভূমি অফিসে গেলে, টিসিবির কার্ড পেতে, হাসপাতালে গেলে- দালালের খপ্পরে পড়েন। সেই দালাল আবার স্থানীয় আওয়ামীলীগের পদধারী।
প্রবাসে গিয়ে নিজের জীবন পরিবর্তন করতে, প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটাতে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠাতে পাসপোর্ট প্রয়োজন। পাসপোর্ট পেতে খরচ করতে হয় অতিরিক্ত টাকা। ভেরিফিকেশনের নামে পুলিশের হয়রানি। দিনের পর দিন পাসপোর্ট অফিসের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে অসহায় নিরব আর্তনাদ।। প্রবাস থেকে ফেরার সময় এয়ারপোর্টে পশুর মতো ব্যবহার।
ট্রেড লাইসেন্স করতে সিটি কর্পোরেশনে গেলে হয়রানির শেষ নেই। জয়েন্ট স্টক নামক অফিস যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে এক অন্য জগত। গোয়েন্দা সংস্থার নো অবজেকশন ছাড়া কোন কাজ হয়না। অথচ দালাল ধরলেই সব পানির মত সহজ। চাকুরির বাজার মন্দা। সরকারি চাকুরি হাতেগোনা। যা আছে তাও সরকারি দলের সার্টিফিকেট ছাড়া হয়না। ‘পাঠাও’ মোটর সাইকেল বা গাড়ি চালিয়ে কোনমতে জীবন ধারণের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন। সেখানেও ঘুষ দুর্নীতি। দিনের পর দিন বিআরটিএ অফিসে জুতার তলা ক্ষয়। আর মাসুদদের ধরে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করলে সব ভোজবাজির মতো হয়ে যায়। অন্যথায় এ যেন হয়ে থাকে সোনার হরিণ।
প্রতিবছর দেশে পঞ্চাশের এর অধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে চাকুরি উপযোগী হয় লাখ লাখ শিক্ষার্থী। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও কোটার খপ্পরে পড়ে শেষ মুহূর্তে সরকারি চাকুরির সকল আশা শেষ হয়ে যায় তাদের। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে যাকে তাকে জামাত শিবির বিএনপি বানিয়ে দিয়ে চাকুরি বঞ্চিত করা ছিল বৈধ। সরকারি দলের সার্টিফিকেট ছাড়া চাকুরি না হওয়া। টাকা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করে নির্দিষ্ট প্রার্থীদের চাকুরির ব্যবস্থা করা ছিল ওপেন সিক্রেট।
বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন খেতে হয়। নিত্য পণ্য না কিনে উপায় নেই। কদিন পরপর এক একটি পণ্য নিয়ে জনগণের সাথে হাস্যরস করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা সিন্ডিকেট। যাদের দৃশ্যমান রূপ বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানি। তাদের ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না। কেবল উপলব্ধি করা যায়। তারা যেন আরেক সরকার। আর সরকার প্রধান সংবাদ সম্মেলন করে মাংসের দাম বাড়লে কাঁঠাল খেতে পরামর্শ দেন, ডিমের দাম বাড়লে ফ্রিজে ডিম সংরক্ষণ করে রাখতে বলেন, পেঁয়াজের দাম বাড়লে পেঁপে খেতে বলেন। আলুর দাম বাড়লে মুলা দেখান। মরিচের দাম বাড়লে মরিচ ছাড়া কিভাবে রান্না করা যায় তার মন্ত্র বাতলে দেন। সাধারণ মানুষ তখন ভাবেন উনি কে ? কোথা থেকে এলেন? এভাবেও কি জনগণের সাথে হাসি তামাশা করা যায়!
পুলিশ মানে জনগণের বন্ধু। যে কোন বিপদে পুলিশের কাছে গেলে নিরাপদ বোধ করার কথা। গত বছরগুলোতে পুলিশ নিজেই হয়ে পড়েছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। মানুষের শান্তি বিনষ্ট করে বিপদ তৈরি করে তাকে গুম-খুনের ভয় দেখিয়ে তার অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করায় যেন তাদের আসল কাজ। এসব কাজে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় একটি অংশ। এর ব্যত্যয় হওয়ায় কত মানুষ যে খুন হয়েছে গুম হয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা রাজনীতি করতো না। অনেকেরই ক্ষমতার সাথে কোন বিরোধও ছিলনা। অপরাধ ছিলো তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কিছু অর্থ সম্পদ অর্জন করেছিলো। শুধু এই অপরাধে পুলিশি পোশাকে একদল লাইসেন্স প্রাপ্ত ডাকাতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার বদৌলতে পুলিশের এই অংশ তাদের ব্যক্তি খায়েশ পূরণের ঘৃণ্য খেয়ালে মেতেছিল।
বিচার বিভাগের কথা তো বলাই বাহুল্য। বিচারের নামে প্রহসন নিয়তি লিখন হয়ে পড়েছিল। মহামান্য ফ্যাসিস্ট ঈশ্বরের ইশারায় বিচার হতো । গণঅভ্যুত্থানের সুত্র ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল এমনি এক ইশারা রায়। এক বিচারক নামের দলীয় কর্মী আপীল বিভাগে যাওয়ার স্বপ্নে ছাত্রদের বিপক্ষে তোষামোদি রায় দিয়ে কোটা ফিরিয়ে আনার পায়তারা করেছিল। ফ্যাসিস্ট ঈশ^রের কৃপা পেতে এ যেন ছিল ‘রায় তোষামোদি’ ব্যবস্থা।
শহর থেকে বন্দরে, রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞলে সবখানে পুলিশ আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগ যুবলীগ, সাংবাদিক নামধারী ছেচড়া, সরকারী কর্মচারী নামধারী দলীয় ভৃত্য সাধারণ মানুষের জীবনকে এতটাই বিপন্ন করেছিল যে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল। ওষ্ঠাগত প্রাণের বেদনার কথা কোথাও বলারও সুযোগ ছিল না। পত্রিকা টেলিভিশন তোষামোদের বাক্সে পরিণত হয়েছিল। সাধারণের বক্তব্য সেখানে প্রচার করার সুযোগ ছিল ক্ষীণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে নূন্যতম প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ রুদ্ধ করে দিয়েছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। এ যেন এমন ‘তোমাদের মুখ বন্ধ, তোমাদের চোখ বাঁধা, তোমরা বোবা, নিষ্পেষিত হওয়ায় তোমাদের নিয়তি।’ শুধু একটি কথাই বলবে, ‘শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই, তার হাতেই দেশ নিরাপদ?’
এমন এক বাস্তবতায় মৃত্যুঞ্জয়ী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে জনতার সম্মিলিত সকল ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটেছিল রাজপথে। আওয়ামী পেটোয়া বাহিনীর অত্যাচার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে দলীয় গুণ্ডাদের অস্ত্র, ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আরও একবার ফ্যাসিস্ট হটিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ নেয় বাংলাদেশের ছাত্র জনতা।
গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা গণমানুষের। যাদের নামে পরিচালিত হয় সরকার। যারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মালিক। গণঅভ্যুত্থানের ৩ মাস পূর্তিতে গণমানুষের অনুভূতি কেমন? কিভাবে গণমানুষ বুঝতে পারবে আগস্ট-পূর্ব বাংলাদেশ এখন আর নেই। সংবিধান পরিবর্তনের আদর্শিক বক্তব্য, সংস্কারের আলাপ, বাজার থেকে পলিথিন বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এয়ারপোর্টে নিরব এলাকা ঘোষণা নাকি বাজারে নিত্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ ব্যবস্থার উপর কার্যকর পদক্ষেপ, জন দুর্ভোগের সরকারী অফিস: ভূমি, পাসপোর্ট, থানা, বিআরটিএসহ সব ধরণের সরকারি অফিসে জনগণের সেবা প্রাপ্তিকে সহজ, হয়রানিমুক্ত ও দ্রুততরকরণ।
যদি গণমানুষ এসব স্থানে গিয়ে এখনো শেখ হাসিনা আমলের মতো হয়রানির শিকার হন তবে বুঝতে হবে গণঅভ্যুত্থান গনমানুষের অনুভূতির বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরাচারের কারণে ফ্যাসিবাদের হালুয়া রুটির ভাগ খাওয়া দোসররা সাধারণ মানুষের সকল সাংবিধানিক সুযোগ প্রাপ্তি কঠিন করে দিয়েছিল। হয়রানি গণমানুষের কপাল লিখন হয়েছিল যেসব স্থানে সেখানে গণমানুষের সেবা প্রাপ্তি সহজ, দ্রুত, দুর্নীতিমুক্ত এবং সম্মানের করা গেলেই গণঅভ্যুত্থানের গণঅনুভূতি জারি রাখা সম্ভব। তবেই যে কোন ফ্যাসিস্টের ফিরে আসার হুমকি কিংবা নতুন কোন ফ্যাসিস্টের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা সমূলে নস্যাৎ করা যাবে।
অন্যথায় গণঅভ্যুত্থানে গণঅনুভূতি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাবে। নেতৃত্ব হয়ে পড়বে গণমানুষের শক্তিহীন ছাত্রনেতা। গণঅভ্যুত্থানের অনুভূতি গণমানুষের হৃদয়ে জাগরূক থাকুক। জীবন বদলে, আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হউক।